লঞ্চ ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়েছে৷ সাইরেন একটানা বেজেই চলেছে৷ এখন ই এই রূপোর শহর, রূপালি ইলিশের নগর চাঁদপুর ছেড়ে ছুটবে মায়ানগরীর দিকে। অগণিত স্রোতের বুকে ঝপাশ ঝপাশ শব্দ করে। ভোরের আলো ফুটে উঠছে মাত্র। কি আশ্চর্য! নদীর বুকে সূর্যটাকে আজ একটু বেশি ই রক্তিম লাগছে। কিন্তু এ আলোয় কোনো উত্তাপ নেই, আছে এক কোমলতা।
-“তারেক?”
হঠাৎ কোনো নারীকন্ঠে ধ্যান ভাঙে তারেক সাহেবের। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে। চোখের চশমাটা খুলে চোখ মুছে আবার চশমাটা পরে পেছনে ঘুরলেন। সামনের এই নারীমূর্তিটি তাকে খানিক বিস্মিত করেছে। হয়তো চিনতে পারছেন, হয়তো না। মিনিট দুয়েক কি যেন ভেবে মুচকি হেসে বললেন,
-“কেমন আছো, তন্বী?”
-“তুমি আমায় চিনতে পেরেছ!”
-“(অবজ্ঞার হাসি হেসে) কিছু কিছু জিনিস ভুলে যাওয়া অনেক কঠিন। আমরা ভুলে যেতে চাইলে বার বার মনে পড়ে যায়। তোমাকেও ভুলে যেতে চেয়েছিলাম, তাই বার বার মনে ই পড়ে গেল,ভুলতে পারিনি।”
-“তুমি এখন ও আগের মতোই আছো। শুধু একটু বুড়িয়ে গেছ, এই যা। ”
এবার তারেক ভালো করে তাকালো। ত্রিশ বছর আগের তন্বীর সাথে এই তন্বীর কোনো মিল ই নেই, মুখের আদলে আগের সেই চঞ্চলা ভাবটার পরিবর্তে এসে ভর করেছে এক গুমোট হাওয়ার মতো বিষন্নতা।মেদের ভীড়ে সেই লাবন্য হারিয়ে গেছে, চুলে পাক ধরেছে, শাড়িতে আগে তন্বীকে দারুন লাগতো, যখন পহেলা বৈশাখ কিংবা বসন্ত উৎসবে তন্বী শাড়ি পরতো, তারেক শুধু একবার দেখার জন্যই শাহবাগ থেকে সাভারে চলে যেত। কিন্তু আজ যেন সেই নারীটি হারিয়ে গেছে, তার জায়গায় যাকে বসানো হয়েছে তাকে শাড়িতে আর মানাচ্ছে না। তবু তারেকের বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়। ভালোবাসা বোধহয় বয়স, শরীর, রূপ এসবের ধার ধারে না, ভালোবাসা ধ্রুব একটি বস্তু, শুরুতে যতটুকু দিয়ে শুরু হয়, শেষ পর্যন্ত ততটুকুই থাকে। তীব্রতা বোঝার জন্য দরকার তো শুধু একটু অনুভুতির। প্রথমে হয়তো এর তীব্রতা বোঝা যায় না। ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তারেক একটু মুচকি হেসে বললো, “হয়তো”।
-“তুমি কেমন আছো তারেক?”
-“এইতো, আছি বেশ, যেমন তুমি দেখতে চেয়েছিলে। তেমন ই আছি। তোমার কথা বলো, তোমার স্বামী সংসার, কেমন চলছে?”
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে তন্বী বলে উঠলো,
-” আমার স্বামী দুই বছর আগেই মারা যান, বড় ছেলে লন্ডনে সেটেল, বউ বাচ্চা নিয়ে সেখানেই থাকে। ছোট ছেলে আছে সিংগাপুরে। কদিন হলো বিয়ে করেছে। এখানে আমি ছোট মেয়ের কাছে থাকি। ”
-“ওহ আচ্ছা”।
– “তোমার খবর বলো তারেক, তোমার স্ত্রী, সন্তান কেমন আছে?”
এমন প্রশ্নে তারেক কিছু সময় চুপ করে থাকে। তারপর কি যেন ভেবে বলে
-“হ্যা, অনেক ভালো আছে সবাই। আমার স্ত্রী ঢাকায় ই আছে, তার কাছেই যাচ্ছি। ছেলেমেয়ে এখন ও পড়াশোনা করছে।”
একটানে কথাগুলো বলে থামলো তারেক। মনে মনে একটা অবজ্ঞাসূচক হাসি দিল, অথচ এটা বলতে পারলো না,” তুমি চলে যাওয়ার পর আমি কাকে এই বুকে ঠাঁই দেব বলো! এখন ও যে তোমার সাথে সেই মধুর স্মৃতিগুলো নিয়ে ভাবি। ”
তন্বী শুনে একটু মুচকি হেসে বললো, ” বাহ, ভালোই তো।”
-“তনু?”
-“হুম”
হঠাৎ তন্বীর হুশ ফের, তারেক ওকে তনু বলে ডেকেছে! তন্বী বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। আজ কতগুলো বছর পর সেই ভালোবাসার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। কিন্তু জীবনের এই একটা মুহুর্তে এসে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। কি হতো সেদিন তারেকের হাত ধরলে? মাঝপথে ওকে ছেড়ে দিয়ে নিজের ভালোর জন্য একজন ধনী ব্যবসায়ীকে বিয়ে না করে যদি সেই এক ফালি চাঁদের আলোর মতো ভালোবাসাটাকে আঁঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতো, তবে আজ এই দিন টা দেখতে হতো না।
কিন্তু ভাগ্য কার জন্য কোন আশ্চর্য তৈরি করে রাখে সেটা বোঝা মুশকিল। একটা মানুষকে ধোঁঁকা দিয়ে বিনিময়ে ভালো কিছু পাওয়ার আশাটা বোকামি বই কিছুই নয়। তন্বীর আজ দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া হয়তো করার কিছুই নেই। জীবনের এই সময়টাতে এসে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। কি যেন মনে করে তন্বী আবার বলে উঠলো,
-“আমায় কি ক্ষমা করেছ তারেক?”
-“ক্ষমা করার কি কোনো কারন ছিল? ”
-“আমি তো তোমার কাছে অপরাধী”
-“ভুল বললে তন্বী, তুমি নিজেই নিজের কাছে অপরাধী৷ ক্ষমাটা নিজের কাছেই চাও। আমার সাথে কিছুই করোনি। করেছো তুমি নিজের সাথে। নিজের ভালোবাসার সাথে। নিজের দেওয়া প্রতিটা ওয়াদার সাথে। তাই যদি সত্যিই নিজেকে অপরাধী মনে হয় তবে নিজেকে প্রশ্ন করো, তুমি নিজের কাজের জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পেরেছ তো!”
তন্বীর আর কিছুই বলার থাকে না এরপর। একটা মানুষ অন্যের কাছে ক্ষমা চাইতে পারে। কিন্তু যখন অনুশোচনায় ভোগে আর নিজের কাছেই নিজে দোষী হয়ে পড়ে, তখন জগতের কোনো যুক্তিই তাকে নিরপরাধ প্রমান করতে পারে না। নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হয়। তন্বীর চোখ দুটো ভিজে আসছে। তারেকের চোখ এড়ালো না। না, সে আর এই মায়ার জালে জড়াতে চায় না। এখানে প্রতিটি মায়াকনার একটা সূক্ষ্ম কাটা তাকে প্রতিনিয়ত যন্ত্রনা দেবে। এর চেয়ে মায়াটাকে কাটিয়ে উঠতে পারাটাই সবচেয়ে ভালো নয় কি?
তারেক বাইরে তাকালো, নদীর বুকে সূর্যের আলোর ঝিলিক তুলছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো ষোড়শী তরুনি সাঁতরে বেড়াচ্ছে, তার রূপোয় মোড়া শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন তন্বীকেও ঠিক এইরকম এক চঞ্চলাবতী তরুণী মনে হতো। আজ সময়ের সাথে সাথে সেই তরুনীর চাঞ্চল্য হারিয়ে গেলেও মনের কোনে তার জন্য রেখে দেওয়া ভালোবাসা টুকু হারিয়ে যায় নি। কিন্তু ঘৃনার চার দেয়ালে আবদ্ধ ভালোবাসাকে বের করে আনা সহজ নয়।
-“মায়ানগরী চলে এসেছে তন্বী, যেতে হবে আমায়। ভালো থেকো।”
এইটুকু বলেই তারেক দ্রুত চলে গেল, সে জানে এখানে থাকলে শুধু একটা চাপা কষ্ট ই তাকে ঘিরে ধরবে। কি লাভ আর মায়া বাড়িয়ে?
মায়ানগরীর দু’প্রান্তে দুটো প্রাণ আবার হারিয়ে যায়, মায়ানগরী তাদের জড়িয়ে নেয় মায়ার চাদরে।
লেখকঃ নুসরাত জাহান অনন্যা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
অর্থনীতি বিভাগ