রাকিব হোসেন আপ্র, ২৫ জানুয়ারী :
বোরো ধান রোপন হচ্ছে যে জমিতে, তার পাশের জমিতে চলছে মাটি লুটের মহোৎসব। ভেকুমেশিন দিয়ে অন্তত ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর করে মাটি কাটা হচ্ছে ওই জমি থেকে। ৬ চাকা বিশিষ্ট ট্রাক্টরে করে এসব মাটি যাচ্ছে স্থানীয় ইটভাটা ভাটাগুলোতে, ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে।
এভাবেই এক এক করে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার দেহলা, সমেষপুর, সিরুন্দী, শাকতলা ও সাহারপাড়া গ্রামের প্রায় ৮ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত একটি ফসলি মাঠ ল-ভ- করে দেয়া হয়েছে।
কৃষক ও জমির মালিকদের অনেকটা জিম্মি করে ফসলি জমির মাটি লুটের উৎসবে মেতে রয়েছে স্থানীয় ইটভাটা মালিক ও মাটির দালালরা। ফসলের মাঠে অসংখ্য ভেকু ও ট্রাক্টরের এমন কর্মযজ্ঞ লক্ষ্মীপুর জেলার অন্য কোথাও এর আগে দেখা যায়নি। আর এসবই নিয়ন্ত্রন করছে ক্ষমতাসীন দলের একটি প্রভাবশালী মহল।
স্থানীয়রা জানায়, রামগঞ্জ উপজেলার ভোলাকোট ইউনিয়নের দেহলা ও ভাদুর ইউনিয়নের সমেষপুর গ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকার ওই ফসলি মাঠে প্রচুর ধান, গম ও শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল চাষ হতো। কিন্তু গত কয়েক বছর আগে এ মাঠের পাশে বেশ কয়েকটি ইটভাটা স্থাপন করে একটি প্রভাবশালী চক্র।
এরপর থেকে এখানে চাষাবাদের জমি কমে ফসল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া আর ফসলি জমির মাটি লুটের কারণে এখানে চাষাবাদ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ফসলি মাঠটি পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী। এছাড়াও ইটভাটায় লাকড়ি ও বিষাক্ত কেমিক্যাল পোড়ানোর কারণে যেমনি পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, তেমনি মাটিবাহী অবৈধ ট্রাক্টর ও হাইড্রোলিক পিকআপ ভ্যানের চাপায় নষ্ট হচ্ছে পাকা সড়ক।
স্থানীয় কৃষক আবদুল কাদের বলেন, ‘প্রথমে যেকোনো মূল্যে একটি জমির মাটি কাটার সুযোগ নেয় ইটভাটা মালিক বা মাটির দালালরা। তারা প্রথম জমিটি এমনভাবে খনন ও পরিবহণ করে যেন আশেপাশের জমিগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অন্য জমির মালিকগণ বাধ্য হয় মাটি বিক্রি করতে।
একটি জমির অতিরিক্ত গভীরতার কারণে আশেপাশের জমিতে ভাঙন দেখা দেয়। ফলে প্রয়োজন মতো হালচাষ এবং সেচের পানি দেয়া সম্ভব হয়না। এছাড়াও ফসলি জমির ওপর দিয়ে ৬ চাকা বিশিষ্ট ট্রাক্টর চলাচলের কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হয়। এভাবে ফসলি জমির মাটি বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে।’
মোঃ সবুজ নামে অন্য এক কৃষক বলেন, ইট দিয়ে বড় বড় দালান-কৌঠা নির্মাণ হয়, এটা শুধু বড় লোকের চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু চাষাবাদ করে উৎপাদিত ফসল ধনী-গরিব সব মানুষেরই খাদ্যের চাহিদা মেটায়। এখন বলেন কোনটা বেশি দরকারি?
দেহলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মাটিবাহী ট্রাক্টর ও পিকআপ ভ্যানের অবাধ চলাচলের কারণে গ্রামীণ সড়ক গুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একদিকে সড়কে খানাখন্দ সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে বৃদ্ধ ও শিশুরা প্রায়ই দুর্ঘটনা কবলিত হচ্ছে।’ বালিতে পুরো এলাকায় ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে ফসলি জমির মাটি লুট এবং ইটভাটা মালিক ও মাটির দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি তুলে ধরেন আহমেদ জাকারিয়া নামে এক ভুক্তভোগী। এ অভিযোগের অনুলিপি রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং থানার অফিসার ইনচার্জসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয় বলে জানা গেছে।
এ অভিযোগে স্থানীয় ভোলাকোট ইউনিয়ন পরিষদের বহিষ্কৃত চেয়ারম্যান বশীর আহমেদ মানিক, দুলাল পাটওয়ারীসহ একটি সন্ত্রাসী চক্র মাটি, নিষিদ্ধ ট্রলি ব্যবসা ও দালালির সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়।
রামগঞ্জ উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী জাহিদুল হাসান জানান, মাটিবাহী ট্রাক্টর ও হাইড্রোলিক পিকআপ ভ্যানের কারণে রাস্তা নষ্ট হওয়ার বিষয়টি তারা জানেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার তাদের নেই।
রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাপ্তি চাকমা জানান, ইতোমধ্যে ইটভাটা মালিকদের সতর্ক করা হয়েছে। তারা ফসলি জমির মাটি কাটা বন্ধ না করলে শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এছাড়া জেলার অন্য উপজেলাগুলোর মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের বাঙ্গাখাঁ, দিঘলী, তেওয়ারীগঞ্জ, ভবানীগঞ্জ, চরশাহী, কুশাখালীতেও ইটভাটার জন্য ফসলি জমির মাটি লুটের দৃশ্য দেখা গেছে। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন অবিলম্বে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে হুমকির মুখে পড়বে সম্ভাবনার জেলা লক্ষ্মীপুর।