সানা উল্যাহ সানু, ১০ মার্চ : কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলারে রহস্যময় বিষ্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ ৬জন জেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ ১২জনসহ ২১ জেলে আহত হয়েছেন।
আজ বুধবার (১০মার্চ) মিরাজ হোসেন (২৫) নামের এক জেলের মৃত্যুর পর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ জনে। মৃত ও আহত জেলেদের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়নের চর লক্ষ্মী ও চর রমিজ ইউনিয়নের চর গোসাই গ্রামে।
এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা অবস্থায় তাদের ট্রলারে রহস্যময় এক বিষ্ফোরণে তারা সবাই মারাত্মক দগ্ধ হন।
জেলে ও তাদের পরিবারের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। এঘটনায় পুরো গ্রাম স্তব্দ হয়ে গেছে। এরই মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ বুধবার ১ জন, মঙ্গলবার ১জন, সোমবার ১জন, শনিবার ১জন এবং শুক্রবার ২ জনের মৃত্যু হয়। অগ্নিদগ্ধ আহত আরো ৫জন ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং ১জন বাড়িতে রয়েছেন।
মৃত জেলেদের মধ্যে রয়েছে, চর গাজী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড দক্ষিণ টুমচর গ্রামের মো: নুর উদ্দিনের ছেলে মো: বেলাল হোসেন (২৮), মো: সিরাজুল হকের ছেলে মো: মেহেরাজ (২৬), চরলক্ষ্মী গ্রামের মো: দেলোয়ার হোসেনের ছেলে মো: মিরাজ (২৫), মো: আবদুজ জাহের ছেলে মো: মিলন (৩০), চর রমিজ ইউনিয়নের চর গোসাই গ্রামের মন্তাজল হকের ছেলে আবুল কাশেম মিস্ত্রী (৫৫),আবু তাহেরের ছেলে মো. রিপন মাঝি (৩৮)। অন্যদিকে অগ্নিদগ্ধ আহত চিকিৎসাধীন জেলেদের মধ্যে রয়েছে চর লক্ষ্মী গ্রামের খুশিদ আলমের ছেলে মো: আলাউদ্দিন, কামাল উদ্দিনের ছেলে মো: সাহাবউদ্দিন, আবু তাহেরের ছেলে মো: আবু জাহের, সিরাজুল হকের ছেলে মো: মেহেরাজ উদ্দিন, সিরাজ উদ্দিনের ছেলে মো: মিরাজ উদ্দিনের অবস্থা আশংকাজনক।
এর মধ্যে চর লক্ষ্মী গ্রামের আবদুর জাহেরের দুই ছেলের মধ্যে মেহরাজ (২৬) কে আহত অবস্থায় বাড়িতে দেখা গেছে এবং মো: মিলন মারা গেছেন। এছাড়া এ ঘটনায় আরো ১০ জেলে আহত হয়ে কক্সবাজারে চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে বাড়িতে ও আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে অবস্থান করছে।
বাড়িতে ফিরে আসা চর লক্ষ্মী গ্রামের জেলে মো: শরীফ (২৫) জানান, মেঘনা নদীতে মাছ ধরা নিষেধের কারণে ও পরিবারের অভাব মেটানোর জন্য গত কয়েক দিন আগে তারা একই গ্রামের মনির মাঝির নেতৃত্বে স্থানীয় ২১ জন জেলে মিলে কক্সবাজারে যায়। সেখানে গিয়ে কক্সবাজার জেলার স্থানীয় সোহেল কোম্পানী নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন এফবি ওশিন নামের একটি ট্রলারে করে মাছ ধরতে সাগরে যায়।
ঘন্টায় ৬০ কিমি বেগে ট্রলার চালানোর পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তারা সাগরে জাল ফেলে। মধ্যরাতে তাদের ট্রলারে হঠাৎ বিকট শব্দ পাওয়া যায়। পরপর আরো দুটি শব্দ হয়। এরপর তারা কিছু লোক সাগরে পড়ে যায়, কিছু লোক কেবিনে এলোপাতাড়ি পড়ে থাকে। ট্রলারে থাকা একজন মাত্র লোক রশি ফেলে সাগরে পড়ে যাওয়াদের উদ্ধার করে। এরপর তারা ওপরে উঠে দেখে তাদের সাথে কেবিনে থাকা সবাই বিভৎস্য হয়ে গেছে।
এর একঘন্টা পর আরেকটি ফিশিং ট্রলার এসে ৩ ঘন্টা চেষ্টার পর আমাদেরকে নেটওয়ার্ক এলাকায় নিয়ে আসে। তারপর তারা তাদের কোম্পানীকে ফোন করে বিষয়টি জানালে, কোম্পানী স্পীডবোট পাঠিয়ে তাদের ট্রলার কক্সবাজার নিয়ে আসে।
আহতদের কে প্রথমে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে চট্টগ্রাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলে মো: শরীফ আরো জানান, আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ইঞ্জিনে বিষ্ফোরণ হয়েছে, কিন্ত আমরা দেখলাম আমাদের ইঞ্জিনে কিছুই হয়নি। গ্যাসের সিলিন্ডারগুলো ঠিক ছিল। ট্রলারও ঠিক ছিল। বিষয়টি রহস্যজনক মনে হয়েছে। কিভাবে আমরা এত লোক আহত হলাম, এত লোক মারা গেলাম ? ওই বিকট শব্দটি কিসের ছিল ? আমরা জানি না।
শরীফ অভিযোগ করে জানান, আমাদেরকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর কোম্পানী আজ পর্যন্ত কোন খোঁজ নেয়নি। এদিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাদের ১২ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের বার্ণ ইউনিটে স্থানান্তর করেন। ওখানকার চিকিৎসরা তাদেরকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়।
এদিকে মারাত্মক আহত ও গরীব জেলেদের চিকিৎসা নিয়ে যখন সংকট দেখা দেয় সেসময় খবর পেয়ে তাদের চিকিৎসায় এগিয়ে আসে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্ন নিয়ে’। তারা আহত ১২ জেলেকে গত ২ মার্চ তারিখে ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করায়। পাশাপাশি রোগীদের সেবায় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত করে, চিকিৎসা ও খরচের অর্থ সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ওই ফিশিং ট্রলার এফবি ওশানের মালিক ও কক্সবাজার যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো: শহীদুল হক সোহেল দেশ রূপান্তরকে জানান, আমার ট্রলারটি ছিল নতুন। এ ঘটনায় ট্রলারের ইঞ্জিন, গ্যাস সিলিন্ডারের কোন ক্ষতি হয়নি। তিনি দাবি করেন, কোন বাহিনীর গোলাবারুদ এসে ট্রলারে পড়ে তাতে জেলেরা জ¦লসে যায়।
এ ঘটনায় তিনি কক্সবাজার থানায় জিডি করবেন বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্ন নিয়ে’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, মানবিক দিক থেকে বিপদে পড়া জেলেদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা। তিনি বলেন, চিকিৎসাধীন জেলেদের অবস্থা বেশি ভালো না। তিনি গরীব মারা যাওয়া ও চিকিৎসাধীন জেলে ও তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য লক্ষ্মীপুর জেলাবাসীসহ দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান।
রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাওহীদুল ইসলাম সুমন জানান, অগ্নিদগ্ধ বেশিরভাগ জেলের বাড়িই তার এলাকায়। আর্থিক সঙ্কটের কারণে ওইসব জেলেদের পরিবার চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল মোমিন জানান, কি কারণে জেলেদের ট্রলারে বিষ্ফোরণ হয়েছে তার খোঁজ খবর নিবেন তিনি। অন্যদিকে খবর পেয়ে আহত ও মৃত জেলেদের তালিকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। দুই-এক দিনের মধ্যে তাদের কে সহায়তা করা হবে। অন্যদিকে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয় প্রণীত জেলে সহায়তা নীতিমালা-২০১৯ অনুসারে তারা কোন আর্থিক সহায়তা পাবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানান, সেজন্য তাদেরকে নিবন্ধীত জেলে হতে হবে। তবুও তারা যেহেতু জেলে সে কারণে তিনি প্রস্তাব পাঠাবেন।