মাজেদ হোসেন, ২১ মার্চ:
দালালের দৌরাত্মে নাজেহাল লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগী ও স্বজনরা। ওয়ার্ডবয়দের বখসিস ও নার্সদের দূর্ব্যবহারের আখড়ায় পরিনত হয়েছে সরকারী এই হাসপাতাল বলে অভিযোগ সেবাগ্রহীতাদের। সরকারী হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে বিভিন্ন বেসরকারী ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিকে ভর্তি করাতে কৌশলের আশ্রয় নেয় দালালরা। অন্যদিকে, বর্হিবিভাগে রোগিদের জন্য জনপ্রতি ৩ টাকা টিকেট নেয়ার নির্দেশনা থাকলেও গত ৬ মাস ধরে রোগী প্রতি ৫ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।
রোগী ও স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে পরিদর্শনের সময় এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
এসময় রোগীদের কাছ থেকে ৫ টাকার করে আদায়ের সত্যতা পাওয়ায় হাসপাতালের চিকিৎসক মাহমুদ হাসান ও ইপিআই টেকনেশিয়ান আবদুল বাতেন সেবাগ্রহীতাকে শান্তনা প্রদান করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান।
জানতে চাইলে, টিকিট কাউন্টারে কর্মরত মাষ্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত মোঃ সাইফুল বলেন, কর্তৃপক্ষ রোগী প্রতি ৫ টাকা কারে আদায়ের নির্দেশ দিলে আমার করার কিছু করার থাকে? তাছাড়া রোগীরাও টাকা দিচ্ছেন।।
হাসপাতালে অভ্যন্তরে দেখা গেছে, জরুরি বিভাগ, স্বাস্থ কর্মকর্তার কক্ষ ও মূল গেটের সামনে দালাল ও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা চরম ভীড় । সেখানে মাস্ক ও গ্লাভস পরে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েজন যুবক। তাদের কাজ হাসপাতালে আসা রোগীদের সিএনজি অথবা অ্যাম্বুলেন্স থামার পর কাঁধে করে ভর্তির জন্য নিয়ে যাওয়া।
জরুরি বিভাগের ভেতরেও দেখা গেছে ৪-৫ জন যুবককে। জরুরি বিভাগে রোগী ও স্বজনরা যাওয়া মাত্রই এই যুবকদের তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। রোগীর স্বজনদের পেছনে ঘুরতে থাকেন তারা। কী রোগ, কী করবেন তা জানার পরপরই সুযোগ বুঝে স্বজনদের অন্যত্রে বাগিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। স্বজনদের বলেন, ‘ক্লিনিকে ভালো চিকিৎসা হবে। স্যার ভালো করে দেখবেন। এখানে চিকিৎসা হয় না।’
শিশু সন্তানকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা সিমু আক্তার নামের চরপাতা গ্রামের একজন নারী ৫ টাকায় টিকেট নিয়ে তার অসুস্থ দুই শিশুকে নিয়ে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তারের অপেক্ষায়। তার সাথে চরমোহনা গ্রামের বিথি আক্তার নামের আরেক নারীও ডাক্তারের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ডাক্তার কোথায় আছেন কেও বলতে পারছেন না।
এসম দু’জন ব্যক্তি এসে রোগীর সম্পর্কে জানার পর তাকে বারবার অন্য হাসপাতালে চলে যেতে রোগীকে বার তাগিদ দিচ্ছেন। আর রোগী অন্য হাসপাতালে ভর্তি করাতে ডাক্তারের জন্য ৪শ টাকা ও নিজের জন্য ৫০ টাকা দাবি করেন।
তবে, শিশুর স্বজনের কাছে এত টাকা না থাকায় তিনি দালালের কথায় রাজি হননি। এতে ক্ষেপে যান ওই দালাল। তিনি সিমুকে আর জরুরি বিভাগের রিসিপশনেও যেতে দেননি বলে অভিযোগ করেন শিশুর স্বজন সিমু আক্তার।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক হসপিটালেরই কয়েকজন কর্মী জানান, রোগী ভর্তি করার পর পরীক্ষা ও অপারেশনের জন্য ড্রেসিং করতে প্রতিবার ওয়ার্ডবয়কে দিতে হয় টাকা। এক্ষেত্রে সিজার অপারেশন করানো রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ২ থেকে ৫’শ টাকা।
এছাড়া হাসপাতালের কয়েকশ মিটারের সামনেই রয়েছে ৬টি প্রাইভেট হাসপাতাল।
অভিযোগ রয়েছে, দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেও বা হাসপাতাল থেকে অন্য ক্লিনিকে নিয়ে গেলেও চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা অজ্ঞাত কারনে থাকছেন নির্বিকার। ডাক্তারদের ম্যানেজ’ করেই দালালরা হাসপাতালে নিজেদের তৎপরতা চালান বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
সকাল ১১টায় ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করা কয়েকজন বৃদ্ধা নারী রোগী বলেন, ডাক্তার ঠিকমতো আসেন না। হাসপাতালের প্রায় সব বিভাগের সবার আচরণই খারাপ। কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করলে ঠিকমতো উত্তর পাওয়া যায় না। ভর্তিরত রোগীদের সাথেও নার্সদের ব্যবহার আরও খারাপ। স্যালাইন বা ব্যাগের রক্ত শেষ হয়ে গেলে খুলে দিতে বা রোগীর প্রয়োজনে তাদের ডেকেও পাওয়া যায় না। বার বার ডাকলে দূর্ব্যবহারের শিকার হতে হয়।
হায়দরগঞ্জ থেকে আসা রোগীর স্বজন ও সোনাপুর গ্রাম থেকে আসা রোগীর জন্য ওয়ার্ডবয়দের সম্পর্কে একই তথ্য দিয়েছেন।
দালালের দৌরাত্ম্য বিষয়ে ইউএনও সাবরীন চৌধুরী সাথে যোগাযোগ করলেও তিনি জানান, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসব বিষয়ে রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার জাকির হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটে। উপজেলা আইনশৃংখলা সভায়ও দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। নার্সদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যেন তারা রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করেন।