মাহমুদ ফারুক: মোঃ সাজ্জাদ মোস্তাকিম, বয়স মাত্র (১৪), বাবা রামগঞ্জ উপজেলা শহরের একটি জুতার দোকানে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসাবে কর্মরত। ভোরে চলে আসেন দোকানে। দোকানে ব্যস্ততা থাকায় কখনো কখনো দুপুরের খাবার খেতে যেতে পারেন না বাড়ীতে। ছেলে মোস্তাকিম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত। মাঝে মাঝে বাবার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে আসতেন সাইকেলে করে। সুযোগ পেলে বন্ধু বা সমবয়সী কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসতেন মোটর সাইকেল।
বাবা ছেলেকে প্রায়ই বলতেন, মোটরসাইকেলে করে যেন তার জন্য যেন খাবার নিয়ে না আসেন। কিন্তু কিশোর ছেলে মোস্তাকিম বাবার কথায় কর্ণপাত করতেন না। ছেলের অগোচরে বাবার দীর্ঘশ্বাস যেন ভারী হতো কয়েকগুন, দূর্ঘটনা বা অজানা আশঙ্কায়।
কিন্তু শেষ রক্ষা যেন আর হলো না।
সাজ্জাদ মোস্তাকিম ও সমবয়সী বন্ধু সানি ও চলতি মাসের ৫ই জুন দুপুরে বাবার জন্য খাবার আনতে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ী দিকে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে পৌর অভিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন সড়কে দ্রুতগতিতে আসা পিকআপ ওভারটেক করতে গেলে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রন হারিয়ে বিদ্যালয়ের দেয়াল ও গাছের সাথে সজোরে ধাক্কা খায় দুজনেই।
মারাত্মক আহতাবস্থায় স্থানীয় লোকজন তাদের দ্রুত উদ্ধার করে নিয়ে আসেন রামগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঐকজনকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর অন্য জনকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে। হসপিটালের চিকিৎসক জানান, সাজ্জাদ মোস্তাকিমের মাথায় ৪০ভাগ রক্তক্ষরণ, বাম হাতের দুটি হাঁড় ভেঙ্গেছে এবং পায়ের ৩টি হাড়ঁ ভেঙ্গেছে। সাজ্জাদ মোস্তাকিম আগামী ৩ মাসের মতো ঠিকমতো কথা বলতে পারবেন না।
একই ঘটনায় যাত্রী মোঃ সানির হাঁটুর উপরের অংশ মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কয়েক জায়গায় ভেঙ্গে গেছে। বর্তমানে ঢাকার পঙ্গু হসপিটালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসক জানান, তার অপারেশন করা জরুরী। সিরিয়াল না পাওয়ার কারনে অপারেশনে বিলম্ব হচ্ছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, ২ জনই পেশায় ছাত্র এবং গরিব পরিবারের ছেলে। প্রতিদিন আয় না হলে ঘরে ঠিকমতো খাবার জুটে না।
একই অবস্থা উপজেলার শেখপুরা গ্রামের মোঃ শাহাদাৎ হোসেনের। বাবা পেশায় ভ্যানচালক। মাস তিনেক পূর্বে দ্রুত গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে রামগঞ্জ হাজীগঞ্জ সড়কের খলিফার দরজা নামক স্থান এলাকায় মারাত্মক দূর্ঘটনায় পতিত হন। স্থানীয় লোকজন রামগঞ্জ উপজেলার একটি বে-সরকারী হসপিটালে নিয়ে আসলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করেন।
অসহায় ভ্যানচালক বাবা, স্থানীয় লোকজনের কাছে হাত পেতে ছেলের চিকিৎসার জন্য টাকা তুলতে বাধ্য হন।
স্থানীয় লোকজন জানান, শাহাদাৎ হোসেন বিগত মাস তিনেক পূর্বে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে দূর্ঘটনায় পতিত হয়ে দেড় মাসের মতো হসপিটাল ও বাড়ীতে শয্যাশায়ী ছিলেন।
রামগঞ্জ উপজেলার পানিয়ালা গ্রামের তুখোড় ফুটবলার জাহীদ হোসেন মিঠু (২০)। বাবা পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। গত ৬ মে ভোররাতে রামগঞ্জ থেকে এলাকার বড় ভাই তারেক মাহমুদ রিপনসহ ঢাকায় যাওয়ার পথে কুমিল্লার গৌরিপুর এলাকায় একটি পিকআপ চাপায় ঘটনাস্থলে নিহত হন জাহিদ হোসেন মিঠু।
এরকম বহু ঘটনা দূর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে রামগঞ্জ-লক্ষ্মীপুরসহ সারাদেশে। পত্রিকা, টিভি চ্যানেল বা ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিনই খবর আসে সড়ক দূর্ঘটনায় বা ট্রাক চাপায় মেধাবী শিক্ষার্থীর মৃত্যু বা স্কুল ছাত্রের মৃত্যুর খবর। যার বেশিরভাগই অল্প বয়সী, কিশোর বা যুবক। বেপরোয়া গতি, লাইসেন্স বিহীন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক।
এছাড়া এক শ্রেণীর যুবক বা কিশোর বয়সীরা গাড়ীর চ্যালেঞ্জার পাইপ খুলে মোটরসাইকেল চালানোর কারনে বিকট শব্দে জনসাধারণের ত্রাহি অবস্থা।
রামগঞ্জ মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের একজন অধ্যাপক জানান, উঠতি বয়সী তরুনদের মারনাস্ত্র হলো মোটরসাইকেল এবং এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন জাতীকে মানসিক প্রতিবন্ধী বানাচ্ছে। আর মোটরসাইকেল কেড়ে নিচ্ছে মূল্যবান জীবন। দুইটি জিনিসের প্রতিক্রীয়া দুই ধরনের।
বাবা মায়ের আদরের সন্তান, বায়না ধরেছেন মোটরসাইকেল কিনে দিতে হবে। মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় প্রতিনিয়ত অশান্তি করছে। হুমকি দিচ্ছেন মোটরসাইকেল কিনে না দিলে আত্মহত্যা করার। অগত্যা বাধ্য বাবা মা।
এছাড়া তিনি আরো জানান, প্রবাসী অধ্যুষিত রামগঞ্জ উপজেলা। বাবা বা বড় ভাই থাকে প্রবাসে। মায়েদের কানের দুলসহ ঘরের মূল্যবান মালামাল বিক্রি করে মোটরসাইকেল কেনার ঘটনাও ঘটছে। জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। অল্প বয়সী কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে সড়ক দূর্ঘটনায় পতিত, খালি করছে বাবা মায়ের বুক। আহাজারি-হাহাকার একটি দূর্ঘটনায় নিহত পুরো পরিবারের জন্য।
স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ করে জানান, কিশোর বা যুবকরা বেপরোয়া গতিতে বাইক চালাচ্ছে, হর্ণ নেই, হেলমেট নেই, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, গাড়ীর রেজিষ্ট্রেশন নেই। তারপরও স্থানীয় ট্রাফিক বিভাগ তা দেখেও না দেখার ভান করছেন। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অধিকাংশ অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোর-যুবক মোটরবাইক চালাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ অজ্ঞাত কারনে নিরব। আর প্রতিনিয়ত মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় পতিত হয়ে আদরের সন্তান অল্প বয়সে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করছেন। কান্না আর দীর্ঘশ্বাস ভারি হচ্ছে উপজেলাবাসীর।
বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী ও সামাজিক সংগঠনের ব্যক্তি জানান, রামগঞ্জ উপজেলার একটি পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড এবং ১০টি ইউনিয়নে এ বিষয়ে মাইকিংসহ ব্যপক প্রচার প্রচারনার ব্যবস্থা করা। লাইসেন্স বিহীন, হেলমেট বিহীন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক কেউ মোটরসাইকেল চালাতে পারবে না।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকদের পাশাপাশি বাবা মা, ভাই বা অভিভাবকদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হলে অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব সড়ক দূর্ঘটনার মতো মারনাস্ত্র। আমাদের সচেতনতা এবং ব্যপক প্রচার প্রচারনা বৃদ্ধিই পারে সড়ক দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেতে।
লেখক: সংবাদকর্মী।
১১-৬-২০২১ইং