কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মজিদ মিয়াকে যখন জজ সাহেব প্রশ্ন করলো, আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, এসব কি সত্য? আর যদি মিথ্যেও হয়, তবে আপনাকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য কোনো আইনজীবী নেই কেনো?
ক্ষণকাল চুপ করে রইলো মজিদ মিয়া। এই ফাঁকে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো সে।
প্রথমেই তাঁকালো জজ সাহেবের দিকে। প্রশ্ন করেছেন তিনি, অথচ প্রশ্নের উত্তর জানার কোনো আগ্রহবোধ করছেন না তিনি।
তারপর তাঁকালো তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত থাকা আইনজীবীর দিকে। আইনজীবীর চোখে উল্লাস ভাসছে। সহজেই একটা মামলা জিতে যাওয়ার আনন্দেই হয়তো এই উল্লাস। রেকর্ড বইয়ে তার আরেকটি জয় লেখা হবে, এবং এরপর তার চার্জ আরো বেড়ে যাবে এই আনন্দ হয়তো তার চোখেমুখে ভাসছে।
তারপর তাঁকালো জজ সাহেব বরাবর সামনে বসে থাকা মানুষদের দিকে। তাদের অবশ্য এই বিচারে কোনো প্রকার ভূমিকা নেই। তারা হচ্ছে দর্শক। কেউ কেউ হয়তো এসেছেন কোনো আসামী পক্ষের হয়ে, কিংবা কেউ কেউ এসেছেন কারো বিরুদ্ধে করা নিজেদের মামলার রায় শুনতে। এদের কারো চোখে কোনোরকম আগ্রহ দেখেনি মজিদ মিয়া। তাদের চোখে কেবল অপেক্ষা আর অপেক্ষা।
একজন আইনজীবী দাঁড়িয়ে বললো, মাননীয় আদালত। এই খুনী অবশ্যই আদালতের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করতে পারে না। তার চুপ থাকাই প্রমান করছে সে অপরাধী। আমরা মহামান্য আদালতের কাছে তার উপযুক্ত শাস্তি দাবী করছি।
মজিদ মিয়া একবার আইনজীবীর দিকে তাকালেন, তারপর দৃষ্টি রাখলেন জজ সাহেবের চোখে। তার চোখেও বিরক্ত দেখতে পেলো মজিদ মিয়া।
মজিদ মিয়া দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে বললো, আমাকে কি এক গ্লাস পানি দেওয়া যাবে মাননীয় জজ সাহেব? তৃষ্ণায় আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।
জজ সাহেব ইশারায় কাউকে বললেন মজিদ মিয়াকে পানি এনে দেওয়ার জন্য।
এবার মজিদ মিয়া অপেক্ষা করতে লাগলেন পানির জন্য। চোখ বন্ধ করলো সে।
চোখে ভেসে উঠলো সে রাতের করুণ দৃশ্য।
দেশ তথা পৃথিবী জুড়ে সব মানুষ ঘর নামক কারাগারে বন্দী। একটা ভাইরাস ক্রমাগত পৃথিবীকে গ্রাস করে নিচ্ছে সব কিছু। দিনের পর দিন গণহারে মানুষ মরছে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে।
খবরের কাগজ, টেলিভিশনের পর্দায়, এমনকি মোবাইল টিপলেও কেবল মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে। তবে এসব খবরের কিছুই জানে না মজিদ মিয়া। একজন রিক্সাচালক হয়ে অবশ্যই খবরের কাগজ পড়ে না কেউ? ঘরে টেলিভিশন নাই। মোবাইল ফোন বলতে মজিদ মিয়া জানে কয়েকটা নাম্বার টিপে কল দিলে কারো সাথে কথা বলা যায়, এই।
দীর্ঘ একমাস থেকে রিক্সা চালানো বন্ধ। রোজগার পুরোপুরি বন্ধ মজিদ মিয়ার। ঘরে যেটুকু সঞ্চয় ছিলো, এসব খুবই নগণ্য। পনেরো দিন টানাটানি করেই সব শেষ। এরমধ্যে সে নিজেও শরীরে রোগ বাধিয়েছে। শরীর ভর্তি জ্বর, সমস্ত শরীর ব্যথা। বমি করতে করতে শরীরে খুব একটা শক্তিও নেই। চাইলেও বাইরে বেরিয়ে কোনো কাজ খুঁজে ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার দিবে সেই সুযোগও নাই।
মজিদ মিয়ার স্ত্রী আলেয়া বেগম এই বাড়ি ঐ বাড়ি গিয়ে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে খুঁজে এনে কয়েকদিন খাবারের জোগাড় করেছে। কিন্তু ভাবে আর কত? মানুষ ই বা কতদিন এভাবে সাহায্য করবে?
বড় ছেলেটা নয় দশ বছর বয়স, কোথাও খেলতে গিয়ে আহত হয়ে এসেছে। হাঁটুর ছাল উঠে গেছে। সেদিন নাক দিয়েও রক্ত ঝরেছে কিছুক্ষণ। কিন্তু কোনো রকম চিকিৎসা করানো হয় নাই। মজিদ মিয়া তো নিজেই এতো অসুস্থ থেকেও একটা ট্যাবলেট পর্যন্ত খায় নাই।
আলেয়া বেগম কয়েকবার বলেছে, যাইয়া দুই একটা ওসুদটোসুদ আইন্যা খাইলেও তো শরীর টা ভালা হই যাইতো।
মজিদ মিয়া কিছুক্ষণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর বললো, গরীবরে আল্লাহ বেশি ভালা জানে বউ। হেল্লাইগা গরীবরে রোগ বেরাম বেশি দেয়। আল্লাহ দেয় আল্লাহ ই সারাই নিবো। অত চিন্তা কইরা লাভ নাই।
আলেয়া ঠিকই জানে স্বামী কেন এসব বলছে। যেখানে পেটে ঔষধ দেওয়া যায় না, সেখানে শরীরে দিবে কি!
গত তিনদিন ধরে ছোট মেয়েটারও জ্বর। বয়স মাত্র দেড় বছর। এইটুকু মেয়ে জ্বরের ঘোরে দিন রাত কাঁদে। মজিদ মিয়া বড্ড বিরক্ত হয়ে উঠেছে। সংসারের এই টানাটানি, অসুস্থতা, ঘরে খাবার নাই, সবকিছু মিলিয়ে ঘরটাতে একটা কবর কবর ভাব চলে আসছে।
বড়রা না হয় দুই এক বেলা না খেয়েই থাকলো। কিন্তু এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলারে কি এইসব বোঝানো যায়?
আকাশে চাঁদ উঠেছে। বাইরে মোটামুটি চাঁদের আলো। মজিদ মিয়া জ্বরের শরীর নিয়াও বের হলো।
আলেয়া বেগম কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো, কই যাইতাছেন?
আছে একটু কাজ আছে। দেহি কিছু ব্যবস্থা করন যায় নাকি। বলেই বেরিয়ে গেলো মজিদ মিয়া।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর, রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। গ্রামে হাকডাক পড়েছে। সবাই চোর চোর করে চিৎকার করছে।
আলেয়া বেগম কোনো গুরুত্ব দেয় নাই এটাকে। দেশের যে অবস্থা, মানুষ তো চুরি করতেই পারে বলে নিজেকে বোঝালো আলেয়া।
রাত দুইটা বেজে গেছে, মজিদ মিয়া ঘরে আসে নাই। ভীষণ ভয় লাগছে এবার আলেয়া বেগমের। লোকটা এই অসুস্থ শরীর নিয়া গেলো কই!
সারারাত বিছানায় এদিক ওদিক করে কাটিয়ে দিলো আলেয়া। মজিদ মিয়া ঘরে ফিরে নাই।
সকালে একটা ছোট্ট ছেলে এসে মজিদ মিয়ার ছেলেকে নাম ধরে ডাকলো। তারপর বললো, কিরে তোর আব্বারে তো বাজারে বাইন্ধা রাখছে। কালকে নাকি চুরি করতে যাইয়া ধরা খাইছে।
কথাটা শোনার পর মনে হয়, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো আলেয়া বেগমের। দ্রুত বাজারের দিকে ছুটলো সে।
একটা কারেন্ট এর পিলারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে মজিদ মিয়াকে। নাকে মুখে ফোটা ফোটা রক্ত। মারছে ভীষণ। আলেয়া বেগম এসব দেখে হা-হুতাশ করতে শুরু করেছে।
বিকেলে চেয়ারম্যান এর অফিসে শালিস বসলো। এলাকার মুরুব্বি, বাচ্চা, যুবক সবার সামনে চুরির অভিযোগ স্বীকার করলো মজিদ মিয়া।
তারপর চেয়ারম্যান রায় দিলো, মজিদ মিয়াকে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হবে। এবং কয়েকজনকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হলো।
ন্যাড়া মাথায় মজিদ মিয়াকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলো আলেয়া বেগম। হাঁটার মতো শক্তিও পাচ্ছে না মজিদ। আলেয়ার কাঁধে ভর দিয়ে কোনো মতে হেঁটে আসলো।
শরীরের ব্যথা, চুরির লজ্জা, পেটের ক্ষুধা। সব মিলিয়ে যেনো উন্মাদ হয়ে উঠেছে মজিদ মিয়া।
পরদিন বের হয়ে সে ইঁদুরের ঔষধ জোগাড় করে আনলেন। রাতে তরকারির সাথে মিশিয়ে দিলো সে। এটা তার স্ত্রীও জানে না। ছেলেমেয়েদের সন্ধ্যায় ভাত খাইয়ে দিয়েছে আলেয়া। নিজেরও ক্ষিদে লাগছে তাই নিজেও খেয়ে নিলো।
এর কিছুক্ষণ পর মজিদ মিয়া ঘরে আসলো। এসে দেখে আলেয়া ঘরের মেজেতে শুয়ে আছে, কোলে বাচ্চা মেয়েটা। পাশেই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বড় ছেলে। মজিদ মিয়া ঠোঁটের কোণায় কিঞ্চিৎ হাসি জমা করলো।
তারপর স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ কাঁদলো। ছেলে মেয়েকে কোলে নিয়েও কাঁদলো সে। তারপর নিজে এক গ্লাস পানির সাথে ইঁদুরের ঔষধ মিশিয়ে নিজেও খেয়ে ফেললো।
কিছু সময় পরই তার শরীর নিস্তেজ হয়ে যেতে শুরু করলো। শরীর ভীষণ ওজন হয়ে আসছে। যেনো হাত-পা নাড়ানোর শক্তিও নেই তার।
মজিদ মিয়ার কেবল চোখে ভাসছে, সে এতোগুলা মানুষকে খুন করেছে। তার ফাঁসি হওয়া উচিৎ। বিচার হওয়া উচিৎ। ক্ষুধার জ্বালা আর চোরের সন্তান হয়ে বড় হতে না দিয়ে সন্তানদের মেরে ফেললো সে।
তার কেবল মনে হচ্ছে ভীষণ তৃষ্ণা লাগছে তার। চোখে ভাসছে একটা আদালত পাড়া। একজন জজ সাহেব। একজন আইনজীবী। আর দর্শক সারীতে বসে থাকা অনেকগুলো মানুষ।
মজিদ মিয়া কেবল মনে মনে হাসলো। আর বললো, এই দুনিয়ার আমার বিচার করার মতো কোনো আদালত নাই। আমার বিচার হবে ঐপাড়ে। আমি নিজেই আমার আইনজীবী হবো সেদিন।
আপনারা কেবল অট্টালিকায় ভালো থাকেন জজ সাহেব। ভালো থাকুন আইনজীবী সাহেবও।
আমি চললাম অচেনা গন্তব্যে..
লেখক: নাঈম ভূইয়া