আজকে যারা কিশোর আগামী দিনে তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অথচ তারা এখনই বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কেউ স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে, কেউ এখনো পড়ছে। এরা এখনই যুক্ত হচ্ছেন বিভিন্ন আড্ডায়। এদের আড্ডায় যোগ দিচ্ছে তরুন বখাটে, ছিনতাইকারী ও মাদক মামলার আসামীরাও। আড্ডার ছলে জড়িয়ে পড়েন কিশোর গ্যাংয়ে। আর বীরত্ব দেখাতে গিয়ে ঘটায় খুনোখুনি, চুরি, ধর্ষণ ও ছিনতাই করছে তারা। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগে টিকটক, লাইকি, ভিডিও বানাতে বন্ধু সহপাঠীর সাথে জড়িয়ে ইভটিজিং, মাদক ও নারী পাচার চক্রের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। পরবর্তীতে এসব কিশোর গ্যাং এর পরিচালনা হয় কথিত বড় ভাইও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। তাদের দিয়ে আধিপত্য বিস্তার দখল মাদক নিয়ন্ত্রণ, পকেট মার, খুন ধর্ষণের মত কাজ করতে থাকেন এবং সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে দীর্ঘ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ও বিভিন্ন অজুহাতে শিশু কিশোরদের হাতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট তুলে দেওয়া।
পরিবার সমাজ ধর্ম ও ভালো বন্ধুবান্ধব কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে, এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রায়ক। এখন এই নিয়ন্ত্রন বিনষ্ট হচ্ছে। আগে কিশোররা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পাড়ার মুরুব্বিরা শাসন করতেন। এখন সামাজিক বাস্তবতায় তারাই ভয় পায়। প্রযুক্তি ও বিশ্বয়ানের সাথে অভিভাবকরা অনেক সময় তাল মিলাতে পারে না। সন্তান কি করে সময় কাটায়। ডিজিটাল ডিভাইসে কি করে তারা বুঝে উঠতে পারছে না। আবার অনেকে মনে করছেন শিশু কিশোররা যে অপরাধ করছে সামগ্রিক বাস্তবতায় এটিকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। ২০১২ইং সালে দেশে কিশোর অপরাধ মামলা হয়েছে ৪৮৪টি, আসামি ছিল ৭৫১ জন শিশু কিশোর। অথচ ২০২০ইং সালের ৬ মাসে ৮২১টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ১৯১ জন। গত ৩ বছরে গুরুতর অপরাধের মামলায় শিশু কিশোররা জড়িত। এর এর মধ্যে ২৪টি খুনের মামলা। এসবের পেছনে রয়েছে বড় ভাই। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হাজারের ও বেশি মামলা বিচারাধীন। এদের বেশির ভাগই বয়স ১০ থেকে ১৮ বছর। ইউনিসেফের হিসেবে বাংলাদেশে শিশু ৩ কোটি ৬০ লাখ।
১৭ইং সাল থেকে শিশু কিশোরদের উন্নয়ন কাজ শুরু করে ৭টি মন্ত্রনালয়, বর্তমানে ১৫টি মন্ত্রনালয় এই শিশুর জন্য কাজ করছে। ২০২০ইং অর্থবছরে মন্ত্রনালয় গুলোর জন্য বরাদ্ধ ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়াসহ ৮০ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।
অনেক মন্ত্রনালয় বলেছে তারা সার্বিকভাবে পরিকল্পনা প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করতে পারছেননা। সরকারি হিসেবে শিশু একাডেমি , স্কাউট, ক্যাব, সৃজনশীল প্রতিভা অন্বেষণের মাধ্যমে ৭ লাখ শিশুর জন্য কোননা কোন ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। বাকীরা এই আওতার বাহিরে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে শিশু-কিশোরদের জন্য জাতীয় শিশু আইন প্রণীত হয়। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে সই করে। এরপর ২০১৩ সালে আসে নতুন শিশু আইন। এর বাইরে শিশু-কিশোরদের নীতিমালা হয়েছে তিনটি। ১৯৯৪ সালে প্রণীত হয় জাতীয় শিশু নীতি। এরপর একই নামে ২০১৩ সালে হয় আরেকটি নীতিমালা। ওই নীতিমালায় আলাদাভাবে কিশোর-কিশোরীদের উন্নয়নের প্রসঙ্গ আছে। এর বাইরে রয়েছে জাতীয় শিশু শ্রম নিরসন নীতি, ২০১০ইং।
এই অঞ্চলে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ নিয়ে প্রথম যে গবেষণাটির খোঁজ পাওয়া যায়, সেটি ১৯৬০ সালের। তখন পুলিশের জন্য ‘স্টাডিজ ইন জুভেনাইল ডেলিনকোয়েন্সি অ্যন্ড কাইম ইন ইষ্ট পাকিস্তান’ শিরোনামে একটি গবেষণা করেন তখনকার কলেজ অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার রিসার্চ সেন্টারের গবেষক সালাউদ্দিন আহমেদ। এরপর ছোট-বড় অন্তত ৭০টি গবেষণার সন্ধান পাওয়া গেছে। পাকিস্তান আমলে কিশোরদের করা অপরাধের শীর্ষে ছিল চুরি, তারপর পকেটমারি। গবেষণায় দেখা যায়, কিশোররা ক্রমশ মাদক, খুন, ধর্ষণ ও মারামারির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
কলকাতার ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর জনপ্রিয় গানে আছে, ‘ছেঁড়া ঘুড়ি রঙিন বল/এইটুকু সম্বল/ আর ছিল রোদ্দুরে পাওয়া বিকেলবেলা/বাজে বকা রাত্রিদিন অ্যাস্টেরিক্স টিনটিন/এলোমেলো কথা উড়ে যেত হাসির ঠেলায়।’ এই গান, অভিভাবকদের ঘুড়ি ওড়ানো কিংবা তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা পড়া কৈশোরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু কিশোর-কিশোরীদের অনেকেই এখন আর এর প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পায় না।
বেশির ভাগ পরিবারের সন্তানের প্রতি মনোযোগ নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং গণিত অলিম্পিডিয়াডের সংগঠক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। তিনি বলেন, অভিভাবকেরা অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত। কারণ, সমাজে অর্থ-বিত্তশালীদের মূল্যায়ন বেশি হতে দেখছেন তাঁরা। একটা সময় ভালো ছাত্র, গাইয়ে, নৃত্য বা আবৃত্তিশিল্পীদের কদর ছিল; এখন নেই। অভিভাবক মুঠোফোনে ব্যস্ত, ছেলেমেয়েরাও।
মুঠোফোন বা প্রযুক্তির অপব্যবহারে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। চলতি বছরের আগষ্টে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) গ্রেপ্তার করেছে এক কিশোর এবং এক কৈশোর উত্তীর্ণকে। সিটিটিসির কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ভিডিও গেমস খেলতে খেলতে তাদের মধ্যে অস্ত্র চালানো শেখার ইচ্ছা জাগে।
পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় না হওয়ায় কিশোরেরা আদর্শহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, এমনটা মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুন্ডু। তিনি বলেন, সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, পরিবারকে অবশ্যই সে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি পথশিশু-কিশোর যারা আছে, তাদের পুনর্বাসন করতে হবে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, এলাকায় প্রভাব বাড়ানো জন্য যারা কিশোরদের হাতে অস্ত্র, মাদক তুলে দিচ্ছে, তারা যে দলেরই হোক, এখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে সবাইকে খেসারত দিতে হবে
বেশিরভাগ শিশুর পারিবারিক কলহ তার উপর প্রভাব পড়ে। অনেকে মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ বা মা-বাবা না থাকা শিশুরা সহজে অপরাধে জড়ায়। অনলাইন গেমস ফাবজি, ফি-ফায়ার খেলে আর এসব গেমস খেলতে অনেক টাকা খরচ হয়, টাকা জোগাড় করতে মা-বাবাকে চাপ প্রয়োগ করে, না দিলে বাসায় ভাংচুর করে। শিক্ষার্থী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন শুরু থেকে শিশু কিশোরদের প্রচুর ভালোবাসা ও সহচার্য দিতে হবে। প্রথমে ছোটখাটো সিম্পটম, বিভিন্ন স্টাইলে চুল কাটা, ড্রেস পরা, আচরণের পরিবর্তন দেখা দিলে মেন্টাল থেরাপি দিতে হবে। প্রয়োজনে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন মানতে কঠোর হতে হবে। সাথে সাথে সৃজনশীল কাজ, গাছ লাগানো ও পরিচর্যা করা এবং মাঠে খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। সাথে সাথে অভিভাবককে নৈতিক চর্চা বাড়াতে হবে। শিশুদেরকে নিয়ে মেডিটেশন করতে হবে। এছাড়াও তাদের জীবনে টার্গেট নির্ধারণ করে দিতে হবে, ছোট থেকে মডেল না হয়ে বিজ্ঞানি হতে উৎসাহ দিতে হবে এবং ভবন তৈরি না করে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। শিক্ষা অর্জনে অধিক হারে বিনিয়োগ করতে হবে।
মোঃ হাবিবুর রহমান সবুজ
শিক্ষক ও সাংবাদিক
sobuz.lax@gmail.com