নিজস্ব প্রতিবেদক: রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাপ্তি চাকমা ও রামগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনসহ প্রশাসনের আন্তরিকতা, সমন্বয় ও ভ্রাতৃত্ববোধের কারনে রামগঞ্জ উপজেলার আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিস্থিতি আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অত্যান্ত চমৎকার বলে জানান এলাকাবাসী। নির্বাচনের আগে এবং পরের ঘটনা নিয়ে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক ধরনের আতঙ্ক লেগেই থাকতো। যা এবারের নির্বাচন পরবর্তি তেমন ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি বললেই চলে।
ইছাপুর ইউনিয়নের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো নির্বাচনী পরিবেশ কিছুটা বিষিয়ে উঠলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, উপজেলা প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কঠোর হস্তক্ষেপ ও নেতৃত্বের কারনে অশান্তির জনপদ খ্যাত রামগঞ্জ এখন শান্তির সুবাতাস দেখা দিয়েছে বলে দাবী করেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
গত পৌরসভা নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত সকল অনুষ্ঠানে ভেদাভেদ ভুলে রামগঞ্জ আসনের সাংসদ ড. আনোয়ার হোসেন খাঁন, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সফিক মাহমুদ পিন্টু, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনির হোসেন চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আ.ক.ম রুহুল আমিন, পৌরসভার মেয়র আবুল খায়ের পাটোয়ারী ও দলীয় নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতি তার কিছুটা ইঙ্গিত দেয়। কিছু ব্যক্তি বিশেষের গাত্রদাহ হলেও দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা এতে সন্তুষ্ট বলেও জানা যায়।
আবু হানিফ নামের এক প্রবাসী জানান, আমি দীর্ঘদিন পর দেশে আসলাম শুধুমাত্র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাত্র ১৫দিন আগে দেশে ফিরেছি। একজন মেম্বার প্রার্থীর পক্ষে ভোটে অংশগ্রহণ করেছি। প্রার্থীদের নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেয়া আর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনায় শঙ্কায় ছিলাম ভোট অবাধ ও সুষ্ঠ হবে কি না। ভোটের আগের দিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র্যাব, বিজিবির উপস্থিতিতে ভোটের দিন পাল্টে গেছে পুরো দৃশ্যপট। হাজার হাজার মানুষ ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত। আমি নিজেও প্রায় ১১ বছর পর ভোট দিতে পেরেছি। শতবর্ষী লোকজনও এসেছেন ভোট দিতে। এরপরও কেন্দ্র দখলসহ হামলা, সংর্ঘষ ও অপ্রীতিকর ঘটনার শঙ্কায় ছিলাম। কিন্তু শেষ ভালো যার সব ভালো তার। কোন ধরনের বড় ঘটনা ছাড়াই নির্বাচন শেষ হয়েছে। আমার পছন্দের প্রার্থী যদিও হেরে গেছে দুঃখ নাই।
ইছাপুর ইউনিয়নের সমিতির বাজারের একজন চা দোকানদার জানান, ভোট দিয়ে বাড়ীর ফিরেছি। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম উঠতি বয়সী ভোটারদের মাঝে ছিলো চরম উৎসাহ। তারা ভোট দিবেই। ঢাকার বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শত শত মানুষের উপস্থিতি ছিলো গ্রামে। ভোটের দুইদিন আগে তারা হাজির গ্রামের বাড়ীতে, উদ্দেশ্য ভোট দিতে হবে। এক ধরনের আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে গ্রামের বাজারগুলোতে। বেচাবিক্রিও মাশাল্লাহ ভালোই হয়েছে। এসময় তিনি জানান, সার্বিক বিবেচনায় ভোট হয়েছে অনেক সুন্দর। নয়নপুর ভোট কেন্দ্রে পূর্ব বিরোধের জেরে ভোটের দিন সংর্ঘষে দুইজন মারা যাওয়ার ঘটনা ছিলো অন্য কিছু।
একই ইউনিয়নের বাসিন্দা ও ঢাকার বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাপড় বিক্রেতা বলেন, আমরা ভোর থেকে নির্বাচনে একজন প্রার্থীর ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে চেষ্টা করি। কিন্তু পথিমধ্যে কিছু দুস্কৃতিকারীরা বাধা প্রদান করলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিষয়টি উক্ত ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়কে জানানোর কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সুষ্ঠুভাবে বাড়ী ফিরে এসেছেন। আমরা প্রশাসন ও ভোটারদের নিকট কৃতজ্ঞ। তবে তিনিও ইছাপুর ইউনিয়নের নয়নপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে সংর্ঘষের ঘটনাটি ভোটকে কেন্দ্র করে হয়নি বলে দাবী করেন।
৯ নম্বর ভোলাকোট ইউনিয়নের একটি ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জানান, একটি দলের পক্ষে ও একজন ইউপি সদস্য প্রার্থীর লোকজন বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেন কেন্দ্র দখলে নিতে। কিন্তু স্থানীয় মানুষের স্বতস্পূর্ত উপস্থিতি আর বাধার মুখে তা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন পর একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পেরেছি।
একই ইউনিয়নের লক্ষীধরপাড়া বাজারের এক তরকারী বিক্রেতা আবদুর রহিম জানান, আমরা অতীতে কখনো দেখিনি এমন ভোট। আমাদের মেম্বার প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। ভোটের পর নির্বাচিত প্রার্থীকে পরাজিত সকল প্রার্থী এক হয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এসময় তিনি একজন প্রার্থীর লোকজনকে অস্ত্রসহ আটকের ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, এসব ঘটনা বিগত নির্বাচনগুলোতে ছিলো ডালভাত। এবারের প্রেক্ষাপট ছিলো সম্পূর্ণ ভীন্ন।
রামগঞ্জ সরকারী কলেজের অধ্যাপক ও একটি ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানান, সংর্ঘষ হামলার পরিস্থিতি এড়াতে আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করি আমাকে যেন দায়িত্ব দেয়া না হয়। কিন্তু শেষ একটি কেন্দ্রের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হই। আমি বিস্মিত হয়েছি, কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই ভোট গণনা শেষ করেছি। প্রার্থীরা রায় মেনে নিয়েছেন কোন ধরনের অভিযোগ ছাড়াই।
৮ নম্বর করপাড়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী সলিম উল্যাহ জানান, টাকা খেয়ে সব ভোট নিয়ে গেছে। আমি হেরে গেছি। কিন্তু পরিবর্তন এসেছে। চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং মহিলা মেম্বার পদে যুবদের জয়জয়কার। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবী করে তিনি জানান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সদস্যদের নিরপেক্ষ ভূমিকায় আমরা খুশি। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছেন এটাই বড় পাওনা।
কলেজ ছাত্র রাইসুল ইসলাম, নতুন ভোটার। তিনি জানান, নির্বাচনের আগে যে আশঙ্কায় আমরা ছিলাম-তা ভোটেরদিন আনন্দে পরিনত হয়েছে। ভোটেরদিন আমার ইউনিয়নে কিছু আতশবাজির শব্দ ছাড়া কোন ধরনের সংর্ঘষ হামলা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এখানে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। আজ পর্যন্ত বিজয় মিছিলের নামে কোন হট্টগোল সৃষ্টি হয়নি। আমরা শান্তি চাই, আর এ শান্তি নিশ্চিত করতে থানা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ জানাই।
রামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দেওয়ান বাচ্চু জানান, বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্রে বিশ^াসী। তার প্রমান রামগঞ্জবাসী ইতোমধ্যে হাতে হাতে পেয়েছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে নতুন মুখ ও যুবকদের উপর মানুষের আস্থা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন তার বহিঃপ্রকাশ। দলকে আরো সুসংগঠিত করতে যার কোন বিকল্প নেই। তিনি এসময় জেলা প্রশাসক মোঃ আনোয়ার হোছাইন আকন্দ, জেলা পুলিশ সুপার, রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাপ্তি চাকমা ও রামগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, রামগঞ্জ উপজেলাবাসী আজীবন তাদের আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের কথা ভুলবে না।
রামগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, সরকারী নির্দেশনা ও মাননীয় পুলিশ সুপার মহোদয়ের দিকনির্দেশনায় আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ দিতে সক্ষম হয়েছি। আর স্থানীয় নির্বাচনগুলো নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। অতিরিক্ত পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল পরিমান সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে বলে তিনি জানান।
রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাপ্তি চাকমা জানান, নির্বাচনে আমরা আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের সর্বাত্মক সহযোগীতা পেয়েছি। মাননীয় এমপি মহোদয়সহ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি-সম্পাদকসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা যেভাবে প্রশাসনকে সহযোগীতা করেছেন, তা প্রশংসার দাবী রাখে। এসময় তিনি সকল দলমত এবং শ্রেণিপেশার মানুষের প্রতি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী, বিজয়ের মাস ডিসেম্বর ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
উল্লেখ্য: গত ২৮ নভেম্বর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ১০ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনে ৬জন স্বতন্ত্র ও ৪জন আওয়ামীলীগের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।